Ancient Indian History | Greek Period
ভারতে বিদেশিদের আগমন
গ্রীক শক ও পহ্বল্লবদের আগমন
ভারতে ব্যাকট্রিয়-গ্রিক আধিপত্য (Greek Empire) :
শুঙ্গ কণ্ব্ বংশের রাজারা যখন ভারতের অভ্যন্তরে রাজত্ব করছিলেন, তখন এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল কার্যত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশের এই রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে এক বিদেশী জাতী ভারতের বিশাল অঞ্চল অধিকার করে বসেন এরাই হলো ব্যাকট্রিয় গ্রিক।
রাজনৈতিক বৃত্তান্ত (Greek Polity) :
উত্তর আফগানিস্তানের বলখ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ছিল ব্যাকট্রিয় রাজ্য। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে হখামনীষীয় সম্রাট প্রথম গ্রিক ব্যাকট্রিয়া অধিকার করেন। সেলুকাসের (Selicus) রাজত্বকালে ডিওডোরাস (Diodorus) নামে জৈনিক গ্রিক ব্যাকট্রিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। স্বাধীন ব্যাকট্রিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠার অতি অল্পকাল পর প্রথম ডিওডোরাস এর মৃত্যু হয়।
প্রথম ইউথিডেমাস :
রাজত্বের প্রথমভাগেই ইউথিডেমাস এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হন। সেলুকিড বংশীয় রাজা তৃতীয় এন্টিওকাস গ্রিক অবরোধ করায় এই রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণে গ্রিক আধিপত্য বিস্তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। এখানে ইউথিডেমাস নামাঙ্কিত সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা পাওয়া গেছে।
ডিমেট্রিয়াস (Demitrious) :
ডিমেট্রিয়াস এর ভারত অভিযানের কাহিনী বিবৃত আছে প্রাচীন গ্রিক লেখকদের বিবরণীতে, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এবং তার উৎকীর্ণ মুদ্রায়। গ্রিক লেখক বলেন আলেকজান্ডারের (Allexender) পর দুজন গ্রিক রাজা ভারত জয় করেন তাদের একজন ডিমেট্রিয়াস অন্যজন মিনান্ডার (Minandar)। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন ভারতীয় সাহিত্যে যে গ্রিক অভিযানের উল্লেখ আছে তার নায়ক হলেন ডিমেট্রিয়াস। ডিমেট্রিয়াস এর বেশিরভাগ মুদ্রার একদিকে দেখা যায় গ্রিক ভাষা এবং গ্রিক লিপির ব্যবহার বিপরীত দিকে লক্ষ্য করা যায় প্রাকৃত ভাষা ও খরোষ্ঠী লিপির প্রয়োগ।
ডিমেট্রিয়াসের বংশধরগণের সঙ্গে ইউক্রেটাইডিসের প্রতিদ্বন্দ্বীতা :
ডিমেট্রিয়াসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ইউক্রেটাইডিস সম্ভবত তার মাতুল সেলুকিড রাজ চতুর্থ সেলুকাসের সাহায্য লাভ করেছিলেন। সেলুকিড রাজ পরিবারের সঙ্গে ইউক্রেটাইডিসের আত্মীয়তার এই বন্ধন সম্পর্কে অনেকের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইউক্রেটাইডিসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যাকট্রিয়ার বসবাসকারী গ্রিকদের সক্রিয় সমর্থনের আশায় এগাথোক্লীস ও এন্টিমেকাস বিশেষ ধরনের স্মারক মুদ্রা প্রবর্তন করেন। সাম্রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিমে শক ও পল্লবদের অভ্যুত্থান পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে।
মিনান্ডার ও পরবর্তী গ্রিক রাজগন :
পশ্চিমে কাবুল (Kabul) হতে পূর্বে মথুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মিনান্ডার সোনা ও রুপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু একজন দিগ্বিজয়ী বীরেই ছিলেন না শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রভৃতি গুণের অধিকারী ছিলেন। ইতিমধ্যেই ইউ-চি গোষ্ঠীর তাড়া খেয়ে শকরা পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ব্যাকট্রিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পরবর্তী রাজাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এন্টিয়ালকিডাস।
গ্রিক প্রভুত্বের বিলোপ :
এন্টিয়ালকিডাস এবং লিসিয়াসের মৃত্যুর পর পল্লব জাতির নিরন্তন আক্রমণ ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে গ্রিক শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান পহল্লব আক্রমণে বিপর্যস্ত আত্মরক্ষা তাগিদে পরস্পর সঙ্ঘবদ্ধ হন। কাবুল উপত্যকায় হারমেয়সের এর মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকের অভিমত কুষাণ রাজ কুজুল কদফিসেস আক্রমনে হারমেয়সের রাজ্য ধ্বংস হয়।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা (Administration) :
রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা হয়, রাজা ছিলেন গ্রিক রাষ্ট্রের প্রাণপুরুষ। রাজা কখনো কখনো শাসনকার্যে উপরাজের সাহায্য গ্রহণ করতেন। ভারত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রীকরা যারা তাদের মুদ্রায় গ্রিক লিপির সঙ্গে ভারতীয় লিপির ব্যবহার শুরু করেন। ভারতীয় অঞ্চল সম্ভবত কয়েকটি প্রদেশে এবং এক একটি প্রদেশে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত ছিল। মেরিডক পদাধিকারী রাজপুরুষেরা জেলার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন।
অর্থনৈতিক জীবন (Economy) :
- পালি গ্রন্থ মিলিন্দপঞ্হ ও গ্রিক ভাষায় লেখা পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি (Periplus of the Erithean Sea) ও রোমক ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম শতকের গ্রীক রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। মিলিন্দপঞ্হ ও প্লিনির (Plini) বিবরণ এ উত্তর-পশ্চিম ভারতের বনজ সম্পদ ও কৃষির বিকাশের বর্ণনা আছে। উল্লেখযোগ্য ফসলের মধ্যে ছিল ধান, গম, যব, জোয়ার বাজরা, কলাই প্রভৃতি খাদ্যশস্য।
- কারিগরি শিল্পেও যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সোনা, রুপা, তামা, সিসা, পিতল, কাঁসা, লোহা প্রভৃতি ধাতু ও মূল্যবান প্রস্রাদি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
- বাণিজ্য চলত চীন, পশ্চিম এশিয়া ও মিশরের সঙ্গে। পশ্চিম এশিয়ার স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা বাণিজ্য চলত। এসময় পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য জিনিসপত্র সঙ্গে গজদন্ত (Ivory) ও মশলা (Spices) রপ্তানি হত।
- মুদ্রায় এই যুগের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে। সোনা, রূপা, তামা, নিকেল এ সময় অসংখ্য মুদ্রা নির্মিত হয়েছিল। সিরকাপের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এ যুগের নগরায়নের চিত্র প্রতিফলিত। তক্ষশিলার এই পরিকল্পিত নগর বিন্যাসের গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট।
সামাজিক জীবন (Social Life) :
গ্রীকদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ভারতে আসার পর বৃত্তের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। মনুসংহিতা ও মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে যবনরা প্রকৃতপক্ষে ক্ষত্রিয় কিন্তু ধর্মচুত বলে শুদ্রে পর্যবসিত হয়েছে। যদিও গ্রিক রাজা মিনান্ডার কে ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
ধর্মীয় জীবন (Religion) :
গ্রীকরা প্রথমদিকে তাদের পুরনো ধর্মীয় আচার আচরণে বিশ্বাস অনুসরণ করতেন। মুদ্রা ও মূর্তির সাক্ষ্য থেকে মনে হয় জিউস, এথেনা, এপোলো তাদের প্রধান দেব দেবী ছিলেন। শুধু মহারাজারা নন গ্রিকদের মধ্যে অনেকেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ আছে। পশ্চিম ভারতের নাশিক কারলা জুন্নরে পাওয়া কয়েকটি দেখে স্থানীয় পদ্ধতি ও বিহারের উদ্দেশে গ্রীক জনগণের দান ধ্যান এর কথা আছে। অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। গ্রীকদের অনেকেই পৈত্রিক ধর্ম ছেড়ে ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
গ্রিক ভাস্কর্য (Architecture) :
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সূরার দেবতা বায়ু ডায়নিসিয়াসের একটি সদৃশ্য মূর্তি তক্ষশীলায় পাওয়া গেছে। অনেক ইউরোপীয় পন্ডিতের ধারণা গান্ধারের গ্রীক শিল্পীরাই সর্বপ্রথম বুদ্ধ মূর্তি তৈরি করেন। গান্ধার শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিল্পীদের বিরাট অবদান অস্বীকার করা যায় না। গ্রিক শিল্পীরাই সর্বপ্রথম দেশীয় শৈলীতে মথুরায় বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব মূর্তি নির্মাণ করেন।
গ্রিকদের অবদান (Contribution Of Greek) :
সাহিত্য, মুদ্রা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা : গ্রীকরা যারা তাদের মুদ্রায় একইসঙ্গে গ্রিক ও প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় মুদ্রার ওপর যে গ্রিক মুদ্রার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল তা অস্বীকার করা যায় না। গ্রীকরা সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। যবনিকা কথার মধ্যেও প্রভাব সহজে লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গ্রিকদের সঙ্গে ভারতীয়দের হয়তো পারস্পারিক ভাব বিনিময় ঘটেছিল। জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু পশ্চিম এশিয়ার ধারণা সমূহ গ্রিকদের মাধ্যমেই এ সময় ভারতে আসে।
0 Comments