গুপ্ত যুগের ইতিহাস। Gupta Dynasty | Ancient Indian History | MCQs

Ancient Indian History | Gupta Dynasty

 গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস

www.gkghor.in
Indian History | Ancient Indian History | Gupta Empire | Gupta Dynasty


                     মৌর্য শাসনের অবসানের পর উত্তর ভারতে আবার এক দীর্ঘস্থায়ী ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ভারতের ইতিহাসে এই রাজবংশ গুপ্ত রাজবংশ নামে পরিচিত। সাতবাহন লেখমালায় গুপ্ত যুগের  তিনজন অমাত্যের উল্লেখ আছে। গুপ্ত রাজ্য বলতে এখানে গঙ্গার তীরবর্তী প্রয়াগ বা এলাহাবাদ, অযোধ্যা এবং মগধ এই তিনটি অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে।


গুপ্ত যুগের রাজনৈতিক ইতিহাস :

মহারাজাধিরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত:

মহারাজ ঘটোৎকচ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত আনুমানিক ৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন। লিচ্ছবিকন্যা কুমার দেবীর পাণিগ্রহণ চন্দ্রগুপ্তের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা ও এলাহাবাদ অঞ্চলে গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। শকদের পরাজিত করে তিনি মগধের দিন শতাব্দীব্যাপী বৈদেশিক শাসনের অবসান ঘটান।


 মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত:

চন্দ্রগুপ্ত ও কুমার দেবীর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত, গুপ্ত বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। সিংহাসন আরোহন করে সমুদ্রগুপ্ত রাজ্য বিস্তারের মনোনিবেশ করেন। সমুদ্রগুপ্তের প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানের ফলে এলাহাবাদের পশ্চিমে গুপ্ত আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। এলাহাবাদ স্তম্ভ লেখে গুপ্ত রাজাদের দক্ষিণ ভারত অভিযান প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এলাহাবাদ স্তম্ভ লেখে হরিসেন সদম্ভে দাবি করেছেন বৈদেশিক রাজারা সমুদ্রগুপ্তের কাছে আত্ম নিবেদন করেছিলেন, তাকে কন্যা দান করেছিলেন এবং তার কাছ থেকে রাজ্য পরিচালনার অনুমতি পত্র লাভ করেছিলেন। দ্বিগবিজয় শেষে সমুদ্রগুপ্ত একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। সমুদ্রগুপ্ত কেবল দূরদর্শী রাজনীতিক রাজা নন, তিনি নানা গুণে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।


              এছাড়াও পরবর্তীতে রামগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, হুন আক্রমণ ও পুষ্যমিত্র প্রভৃতি নানা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব গুপ্ত যুগের লক্ষ্য  করা হয়।


গুপ্তরাজ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা :

গুপ্তযুগে সুদক্ষ রাজপুরুষদের সাহায্যে প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পন্ন হতো। গুপ্ত প্রশাসনে, বিশেষ করে গ্রাম ও জেলার স্তরে জনপ্রতিনিধিত্বের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। প্রশাসনের সুবিধার জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্য কে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। জুনাগর শিলালিপি থেকে জানা যায় স্কন্দগুপ্ত বিভিন্ন দেশগুলিতে গুপ্তচর দের নিয়োগ করেছিলেন। বৈশালীতে প্রাপ্ত সিলমোহরে "রনভান্ডাগারাধিকরণ", "বলাধিকরণ" প্রভৃতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক দপ্তর এর উল্লেখ আছে। গুপ্ত আমলের বিষয়ে আধুনিককালের প্রশাসনিক বিভাগ জেলার মতো। সম্রাট যাকে সরাসরি নিয়োগ করতেন, তিনি সম্ভবত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ছিলেন। প্রশাসনের দুটি ভাগ হলো মন্ডল ও  বিধি।  বিধির নিম্নতর প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। এক একটি গ্রামীণ প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের প্রক্রিয়া ও সমান্তরাল ধারায় বহমান ছিল।


গুপ্ত যুগের সমাজ জীবন: 

গুপ্ত যুগের লেখমালা ও সংস্কৃত সাহিত্যে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উল্লেখ কম, ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের উল্লেখ প্রচুর।  এ সময় বেদজ্ঞ ও ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণদের অনুকূলে নিষ্কর জমি দানের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।  


নারী সমাজ:

গুপ্ত যুগের নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো। সমাজে পুরুষের বহুগামিতা লক্ষ্য করা  হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে পর্দাপ্রথা, দেবদাসী, সতী প্রথা, বিধবা বিবাহ প্রথা প্রভৃতি বিভিন্ন রকম প্রথা আরোপিত ছিল। মেঘদুত তাব্য থেকে জানা যায়, কালিদাসের সময়ে উজ্জয়িনীর বিখ্যাত মহাকাল মন্দিরে অনেক দেবদাসী নিযুক্ত ছিলেন। 


শিক্ষা ও প্রগতিশীল সমাজ জীবন :

বরাহমিহির বিদ্যার চারটি চিরাচরিত শাখার উল্লেখ করেছেন- বার্তা, ত্রয়ী, দণ্ডনীতি এবং  দর্শন। ব্যাকরণ, কবিতা ও কাব্য অধ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। গুপ্তযুগের মধ্যভাগ নাগাদ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। গুপ্ত যুগের সমাজ জীবনে বিপরীতমুখী প্রবনতার সহবস্থান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন বর্ণ ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল, অপরদিকে তেমনি বিবাহ রীতি ও জীবন ধারণের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রম ধর্মের কঠোরতা হ্রাস পেয়ে ছিল। সমাজে সহনশীলতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়ে এক ধরনের বিপরীতধর্মী প্রবণতা সহাবস্থান দেখা যায়। যা প্রগতিশীল সমাজ জীবনের অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিল। 


অর্থনীতি (Economy) : 

কৃষি অর্থনীতি:

৫৯২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বিষ্ণু সেনের একখানি তাম্রশাসনে গুজরাত অঞ্চলে নীল চাষের প্রমাণ আছে। অগ্রহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার এই পর্বের অর্থনৈতিক জীবনকে বিশেষ তাৎপর্য মণ্ডিত করেছে।অগ্রহার ব্যবস্থা বলতে পুরোহিত সম্প্রদায়ের দেবস্থান এবং বৌদ্ধ ও জৈন সংগীতির অনুকূলে নিষ্কর ভূসম্পত্তি বোঝায়।


কারিগরি শিল্প: 

এই পর্বে ধাতু শিল্পী অগ্রগতির লক্ষণ সুস্পষ্ট। সোনা, রূপা, তামা, লোহা, পিতল ও টিন এর উল্লেখ আছে। মনি রত্নাদির কাজে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। অনেক কারিগর গজদন্ত শিল্পে নিযুক্ত ছিলেন। লোহার তুলনায় সোনার চাহিদা কম ছিল।


 মুদ্রা ব্যবস্থা:

ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে মুদ্রাব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় গুপ্তদের রৌপ্য মুদ্রা সংখ্যা কম। তামার মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন কিন্তু তার সংখ্যা সীমিত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, রামগুপ্ত ও প্রথম কুমার গুপ্তের রাজার নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা সন্ধান পাওয়া গেছে। সমুদ্রগুপ্তের আমলে ছয় প্রকার স্বর্ণ মুদ্রা চালু হয়। গুপ্ত রাজারা নানা প্রকার ও বিভিন্ন ধরনের প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। বুদ্ধঘোষ বলেছেন এ যুগে রুপা ও তামা ছাপমারা মুদ্রার প্রচলন অব্যাহত ছিল।


          এছাড়াও নগরায়ন, বহিবাণিজ্য, বস্ত্রশিল্প, চর্ম শিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, তেল উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে। 


গুপ্ত যুগের ধর্ম (Religious Believe) :

ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে গুপ্ত যুগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এসময় বৈষ্ণব ও শৈবধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়। গুপ্ত যুগের প্রথম, ধর্ম আঞ্চলিকতার গণ্ডি অতিক্রম করে এক অলীক ভারতীয় ধর্ম রূপে আত্মপ্রকাশ করে। গুপ্ত রাজারা প্রধানত বৈষ্ণব ধর্মালম্বী হলেও তাদের আমলে শৈবধর্মের যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। শৈবদের এক শাখা পশুপত সম্প্রদায় নামে পরিচিত। মথুরা ছিল এই পশুপত সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র। গুপ্তযুগে যেমন শিব মূর্তির তেমনই শিবলিঙ্গের নিদর্শন পাওয়া গেছে। গুপ্তযুগে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, গণেশ, শিবের অবতার ব্রহ্মা ও বিষ্ণু প্রভৃতি পুজোর রীতি ছিল। 


গুপ্ত যুগের সাহিত্য (Literature):

গুপ্তযুগে একাধিক ধর্মশাস্ত্র রচিত হয়েছে। এই যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আর্য ভট্ট ও বরাহমিহির এর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সাহিত্য ক্ষেত্রে বুদ্ধঘোষ, বসুবন্ধু, ভারবি, বিশ্ব শর্মা, কালিদাস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। "অভিজ্ঞান শকুন্তলম" ও "মালবিকাগ্নিমিত্রম" সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ লেখমালা সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভ লেখ।


গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য:

স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে গুপ্ত যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়ের রূপে চিহ্নিত। ভারতীয় স্থাপত্যের দুটি ভাগ-  প্রস্তুরখোদিত স্থাপত্য ও সৌধ স্থাপত্য। গুপ্ত যুগের স্থাপত্য শিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল-  অজন্তা ও ইলোরা। সমকালীন ভাস্কর্যশিল্পের অনিবার্য হল  ভারত শিল্পের ফুল্লকুসুমিত মহিময় রূপ।

                গুপ্ত যুগ ভারতের ইতিহাসে সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মীয় প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গুপ্ত সম্রাটরা প্রজাদের মনে সম্ভ্রম উদ্যোগের জন্য গালভরা উপাধি ধারণ করেছেন, নিজেদের ওপর আরোপ করেছেন তবুও প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা দিকে তেমন সৃষ্টি দেননি। মৌর্য আমলের এক কেন্দ্রিকতা গুপ্ত পর্বে দেখা যায়নি। এই গৌরবোজ্জ্বল দিকটি আজও ভারতীয় ইতিহাসে আলোচিত থেকে গেছে।



👉মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস


👉 গুপ্তোত্তর যুগের ইতিহাস


Post a Comment

0 Comments