বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন | Partition of Bengal | Modern Indian History

Partition of Bengal | Indian History 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও তার প্রভাব

www.gkghor.in
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন | Partition of Bengal | Modern Indian History | Question Answer


                   ➤1905 সালে বঙ্গভঙ্গ (Partition of Bengal) ও স্বদেশী (Swadeshi Movement) আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। এই আন্দোলনের প্রভাব শুধু বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ ছিল না। এই ঘটনায় একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনের রূপ নেয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের প্রথম গণ অভ্যুত্থান। গৃহস্থ বধু ও ছাত্র থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরের মানুষ এই এই বিদ্রোহের শামিল হয়েছিল। এই আন্দোলনেই কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃত্বে সীমাবদ্ধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সন্দিহান করে তুলেছিল। চরমপন্থী নেতারা এই সুযোগে তাদের মতাদর্শ ও চিন্তাধারা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে বয়কট ও স্বদেশী সূত্রপাত করে যা পরে মহতমা গান্ধীর অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়।


 বঙ্গভঙ্গের কারণ (Causes) :

প্রশাসনিক সুবিধার তাগিদে, নাকি সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে লর্ড কার্জন (Lord Carzon) 1904 সালের 16 ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কার্যকারী করেছিলেন, তা নিয়ে পন্ডিত মহলে যথেষ্ট বিতর্ক ও মতবিরোধ রয়েছে। কার্জনের সমর্থকদের পক্ষে প্রশাসনিক সুবিধার প্রশ্নটিই বড় করে দেখা হয় এবং জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে কার্জনের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও জাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদ কে ধ্বংস করার জন্য চক্রান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। লর্ড কার্জনের প্রতি দৃষ্টিগোচর করে বলা যায় যে, তিনি বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী করলেও এই পরিকল্পনা তার মাথা থেকে প্রথম বার হয়নি। এই বিষয়ে প্রথম যখন ভাবনা চিন্তা করা হয় তখন থেকে শুরু করে 1903 সাল পর্যন্ত প্রশাসনিক প্রশ্নই ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন এত বড় ছিল যে তার প্রায়ই নানা ধরনের প্রশাসনিক সমস্যার সৃষ্টি করত এবং এই বিষয়ে সরকারের যথেষ্ট দুশ্চিন্তা ছিল। এই বিস্তৃত অঞ্চল যথাযথভাবে শাসন করা মোটেই সহজ সাধ্য কাজ ছিল না। স্যার স্টাফোর্ড  নর্থকোট এই বিশাল প্রদেশের আয়তন সংকুচিত করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে বোম্বাই ও মাদ্রাসের মত বাংলার দায়িত্বও একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হোক। তখনকার বড়লাট জন লরেন্স এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তার বিকল্প প্রস্তাব ছিল বাংলার কিছু অংশ আসাম ও তৎসন্নিহিত জেলা গুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যেতে পারে। তার পরিকল্পনার মূল কথা ছিল প্রশাসনের প্রয়োজনে বাংলার আয়তন ছোট করা। এই হল বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সূচনা।


 বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা ও সমর্থন :

প্রধানত প্রশাসনিক প্রয়োজনে হলেও কিন্তু  রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা চতুর্দিকে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী করার আগেই অর্থাৎ রিসলে পত্র প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। 1904 সালে কংগ্রেস প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কংগ্রেস সভাপতি কটন সরকারকে এই পরিকল্পনার প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন রাখেন। যদিও লর্ড কার্জন এতে কোনো রকম কর্ণপাত করেননি। তার কাছে কংগ্রেস ও কলকাতার নেতারাও ভিন্ন ছিল। অর্থাৎ কংগ্রেসের আপত্তি ও বাঙালির মধ্যে কোন তফাৎ খুঁজে পাননি। অন্যদিকে রিসলে বলেছিলেন যে সমাজের উপর তলার স্বার্থন্বেষী কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করবে না।


কংগ্রেসের উভয় গুষ্টি তথা নরমপন্থী ও চরমপন্থী সমর্থকরা তাদের মধ্যে মত ও পথের যাই পার্থক্য হোক না কেন বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেনি এবং উভয় বঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থেই হোক বা জাতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল। আমরা আগেই দেখেছি কিভাবে রিসলে ও কার্জন হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত পথে অগ্রসর হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে কার্জনের পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে নাম মাত্র সুদে ১ লক্ষ পাউন্ড ধার দেওয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব কিছুই করা হয়েছিল মুসলমানদের সমর্থন আদায় করার জন্য। আর এই মুসলিমদের সমর্থন আদায়ে খুবই অগ্রণী ছিল বঙ্গভঙ্গ করার জন্য। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি বক্তব্য সংক্ষেপে বলতে পারি যে, প্রথমত, শিক্ষিত উচ্চ বর্গ ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের বিচ্ছিন্ন করার অশুভ রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি লক্ষ করেছিল। দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মুসলিমরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিল। কারণ এর ফলে তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উৎসাহব্যঞ্জক সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলিম বঙ্গভঙ্গের বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সমাজের উপর তলার সঙ্গে নিচের তলার ব্যাতিক্রম ব্যবধান ছিল। অবশ্য হিন্দু সমাজে এই ব্যবধান স্পষ্ট হলেও মুসলিম সমাজে তা ছিল না।


 বঙ্গভঙ্গ কার্যকর :

1905 সালের 16 ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাবাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। ওই দিনটি পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস হিসাবে। সারা দেশ জুড়ে হরতাল ও ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষ অনশন পালন করে খালি পায়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে ও দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে গঙ্গা স্নান করে। সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নিদর্শন হিসাবে শুরু হলো রাখিবন্ধন উৎসব। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গাইতে গাইতেই বিভিন্ন মিছিল শহর পথ পরিক্রম শুরু হয়। কার্জন ভেবে ছিলেন আন্দোলনের অস্তিত্ব হবে ক্ষণস্থায়ী। তিনি অচিরেই বুঝলেন তার এই অনুমান ভ্রান্ত। বঙ্গভঙ্গ বাঙালিকে বিভক্ত করার বদলে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে।


 বিদেশি দ্রব্যের বয়কট :

প্রবল প্রতিবাদ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সাফল্য নরমপন্থী নেতাদের আবেদন-নিবেদন নীতির ব্যর্থতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিল। সরকার দমনমূলক নীতি অনুসরণ করে সমস্ত আন্দোলন স্তব্ধ করতে সচেষ্ট হল। ছাত্রদের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেখে সরকার জারী করল কার্লাইল সার্কুলার। এই নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি থেকে সরকারি অনুদান প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে, ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অনুমোদন বাতিল করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

এই আন্দোলনের অস্ত্র বা পদ্ধতি হিসাবে বয়কট বা বিদেশি দ্রব্য বর্জনের মধ্যে কোন অভিনত্ব ছিল না। চরমপন্থী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল অনেক বেশি ব্যাপক। তাদের কাছে বয়কটের কর্মসূচি ছিল সর্বাত্মক। অন্যদিকে তারা বয়কটের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদনে যোগ দিলেন। তাদের কাছে বয়কট ও স্বদেশী ছিল একই আন্দোলনের দুটি দিক। স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম ধারার বৈশিষ্ট্য হলো গঠনমূলক স্বদেশী। স্বদেশী শিল্প, শিক্ষা এবং গ্রাম সংগঠন ও উন্নয়নের মাধ্যমে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। এই নীতির ফলশ্রুতি হিসেবে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রচেষ্টায় বেঙ্গল কেমিক্যাল এর প্রতিষ্ঠা, নীলরতন সরকারের ব্যবসায়ী উদ্যোগ ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জাতীয় শিক্ষানীতির ঘোষণা।


 স্বদেশী আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা :

স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন কল কারখানার শ্রমিকরা হরতাল ধর্মঘট পালন করেন। 1906 সালের জুলাই মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে (East India Railway) শ্রমিকরা ধর্মঘটে সামিল হন। পরের মাসেই জামালপুর রেলওয়ে কারখানা ও জুট মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। 1908 সালে কলকাতার টেলিগ্রাফ (Calcutta Telegraph) কর্মচারীরা ধর্মঘটে অংশ নেয়। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বাবুরাও পিছে রইলেন না। এইসব ধর্মঘটের মূল কারণ অবশ্য শ্রমিকদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের প্রতিকার ও নানা দাবি-দাওয়া, কাজের সময়, বেতন, শ্বেতাঙ্গ মালিক শ্রেণীর অত্যাচার প্রকৃতির নানা কারণে শ্রমিকরা অবশ্যই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তাদের এইসব অভাব-অভিযোগ মুলধন করে চরমপন্থী নেতারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করার জন্য শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন।


 স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব :

বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি আঞ্চলিক সমস্যা। পূর্ব ভারতের মানুষের বিশেষভাবে বাঙ্গালীদের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত ছিল। সামগ্রিকভাবে ভারতের মানুষের এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা নয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সারা ভারতের দৃষ্টি বঙ্গভঙ্গের দিকে আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে এই আন্দোলন যখন বয়কট ও স্বদেশী পথ ধরে স্বরাজের লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হয় তখন তা একটি সর্বভারতীয় সমস্যায় পরিণত হয়। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে জাতীয় স্তরের নেতারা ভাবনাচিন্তা শুরু করেন এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব অনুভূত হয়।


        বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার নিঃসন্দেহে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মুসলমান স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন করেছিল। বস্তুত বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবার আগেই 1904 সালের জানুয়ারি মাসে ময়মনসিংহে এবং 1905 সালের আগস্ট মাসে বরিশাল ও শ্রীরামপুরে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে মসজিদে মসজিদে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 1905 সালের 23 শে সেপ্টেম্বর হিন্দু-মুসলিম ছাত্রগণ হাত ধরাধরি করে কলকাতায় এক মিছিলে অংশ নিয়েছিল। রাখি বন্ধন অনুষ্ঠানে মুসলমানরা অনেকে যোগ দিয়েছিল। কয়েকজন মুসলমান জমিদার নবাব আব্দুল গনি চৌধুরী, ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ভাই আতিকুল্লাহ খান বাহাদুর ইউসুফ চৌধুরী, সৈয়দ মোতাহার হোসেন চৌধুরী, আলিমুজ্জামান ইত্যাদি স্বদেশী আন্দোলন কে সমর্থন করেছিলেন।



👉 কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মসূচি

Post a Comment

0 Comments