Great Revolt 1857 | মহা বিদ্রোহ | সিপাহি বিদ্রোহ

 Sepoy Mutiny in 1857


www.gkghor.in
Modern Indian History | Great Revolt 1857 | Sepoy Mutiny | Indian History Question Answer
 


মহাবিদ্রোহ (Great Revolt 1857) : 

ভারতের গণবিদ্রোহের ইতিহাসে ১৮৫৭ সালে প্রথম আঞ্চলিক গন্ডির সীমারেখা ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। অনেকের মতে ১৮৫৭- র এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল।


 

➤ মহাবিদ্রোহের কারণ (Cause) : 

১৮৫৭ সালের ১১ ই মে দিল্লির পতন এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা ভারতের বিভিন্ন স্থানের সিপাহী ও জনসাধারণকে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের ব্যাপারে উৎসাহিত করে তুলেছিল। কায়ে নামে এক পদস্থ ইংরেজ কর্মচারী লিখেছেন সাধারণ নাগরিককেরা ও কোম্পানির রাজকে উচ্ছেদ করার জন্য এই বিদ্রোহের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে বিদ্রোহের পেছনে কোন সংগঠিত পরিকল্পনা ছিল না, তবুও তিনি এক্ষেত্রে অন্তত স্বীকার করেছেন যে সিপাহিদের নিজেদের মধ্যে আগে একটা আলাপ -আলোচনা এবং সমঝোতা হয়েছিল।


  •  রুদ্রাংশ মুখার্জি তার "Awadh in Revolt " : ১৮৫৭-৫৮  নামে সাম্প্রদায়িক গ্রন্থে বলেছেন- গুজব ভীতি এবং আতঙ্ক সিপাহিদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং সহিংস অভ্যুত্থানের পথ গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৫ অগস্ট সম্রাট বাহাদুর শাহ "আজামগড় ঘোষণাপত্র" নামে একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন ।এই ঘোষণাপত্রে ভারতীয়দের তীব্র অসন্তোষ এর পেছনে ধর্মীয় কারণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ১৮৫৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অযোধ্যার যুবরাজ ফিরোজশাহ জারি করা ঘোষণাপত্রে ইংরেজ সরকার কর্তৃক ভারতীয়দের ধর্মান্তরিত করার সক্রিয় প্রয়াসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

  • কোম্পানির কোর্ট অফ ডাইরেক্টর (Court of Director) এর চেয়ারম্যান Mangles ১৮৫৭ সালের হাউস অব কমন্সের রাখা একটি বিবৃতিতে বলেছেন সমগ্র ভারতে খ্রিস্টের পতাকা উড্ডীন রাখতে হবে এবং ভারতকে একটি খ্রিস্টান দেশে পরিণত করার জন্য সকলকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ১৮৫০ সালে প্রণীত ২১ নম্বর আইনে বলা হয়েছিল যে এখান থেকে কোন ভারতীয় ধর্মান্তরিত হলেও সে তার পিতৃ পুরুষের সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে।

  • ১৮৫৭ সালের ৯ই মে হেনরি লরেন্স গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং (Lord Canning) কে লেখা একটি চিঠিতে অযোধ্যা গোলন্দাজ বাহিনীর  জৈনিক জমাদারের ধর্মান্তরিত হবার অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করেছিলেন। এই ধারণা সিপাহীদের মধ্যে এতটাই বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে সিতাপুরে বিদ্রোহ শুরু হবার আগের দিন সেখানকার সিপাহীরা মনে করেছিল তাদের ব্যবহৃত আটা ইচ্ছাকৃতভাবে অপবিত্র করা হয়েছে। সাধারণত বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে এনফিল্ড রাইফেল কার্তুজ বিষয়টি তুলে ধরা হয়, অনেকের মতে এই কার্তুজ টোটা শুয়োর অথবা ষাঁড়ের মাংস দিয়ে তৈরি।

  •  বিদ্রোহের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, সিপাহীদের স্বল্প বেতন এবং তাদের পদন্নতির সুযোগের অভাব। টমাস মনরো লেখা থেকে জানা যায় একজন ভারতীয়  বড়জোর সুবাদার পদ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারতেন আর এই পদের স্থান ছিল সর্বনিম্ন স্তর ইউরোপীয় অফিসারের অনেক নিচে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী ক্রোধের বিস্ফোরণের পথ উন্মুক্ত করেছিল এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই ব্রিটিশবিরোধী অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান লিখেছেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সরকারি উচ্চ পদ প্রাপ্তি থেকে ভারতীয়দের বঞ্চিত করার ব্রিটিশ নীতি বিদ্রোহের অন্যতম।

  • লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতির নগ্ন প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল তার স্বত্ববিলোপ নীতির মধ্যে।এই নীতির সাহয্যে ডালহৌসি একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে দেশীয় রাজন্যবর্গের কোপানলে পড়ে ছিলেন। ১৮৫৬ সালে ডালহৌসি অপশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। বেগম হযরত মহল এর ঘোষণাপত্রে- আক্ষেপের সুরে বলা হয়েছিল সন্ধি চুক্তির সমস্ত শর্ত লংঘন করে এবং নিজেদের কথার খেলাপ করেই ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে।ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে দেশীয়  নৃপতিদের মর্যাদা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হয়েছিল।

  • ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ইংরেজ সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ফলে জনসাধারণের অসন্তোষ এবং ক্ষোভ। উপনিবেশীক শোষণ ও লুণ্ঠনের ফলে ভারতীয়দের জীবনে চরম দারিদ্র্য নেমে এসেছিল। উত্তর ভারতে কর্মরত জৈনিক জেলাশাসক Mark Thornhill এই ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে "নিষ্ঠুর" বলে অভিহিত করেছে। দরিদ্র ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে এই বিধ্বংসী মহাবিদ্রোহের শামিল হয়েছিল।

  • ১৮৪৬  সালে আলিগড়ের কালেক্টর জি.ব্লান্ড একটি প্রতিবেদন লিখেছেন অতিরিক্ত রাজস্বের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়ে আলীগড়, মধুরা ও বান্দা জেলার গ্রামীণ সংস্থাগুলি প্রচুর জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল । যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকায় এবং দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী রাজপুতেরা বিদ্রহী হয়ে উঠেছিল। কারণ তারা সেখানকার নিষ্ঠুর দমনমূলক ভূমি ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি। অযোধ্যার নবাবকে অকস্মাৎ ক্ষমতাচ্যুত করার ফলেই অযোধ্যায় বিদ্রোহ একটি গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল।

  • ১৭৫৭সালের ২৫ই আগস্ট বাহাদুর শাহ্ কর্তৃক প্রচারিত আজামগড় ঘোষণাপত্রে ইংরেজ শাসনের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতীয় জনসাধারণের হতাশা ও ক্ষোভ পরিস্ফুট হয়েছিল। ভারতীয় বণিকরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং ভারতীয় কারিগরদের পণ্যের চাহিদা ক্রমশ লোপ পায়। তাই ইংরেজবিরোধী মহাবিদ্রোহের অংশ নিতে দরিদ্র পীড়িত এসব বলে কারিগররা কুণ্ঠিত হয়নি।


 

➤ মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি (Nature of Revolt) :  

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে জন লরেন্স এবং সিলি এই বিদ্রোহকে স্বার্থপর সিপাহী বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইংলিশ ঐতিহাসিক টি. আর হোমস এর মতে এই বিদ্রোহের সভ্যতা বনাম বর্বরতা সংঘাত প্রকাশ পেয়েছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে সিপাহিদের অভ্যুত্থানের সুযোগে একদল হতাশ সামন্ত প্রভু নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তার মতে এই বিদ্রোহের পেছনে কোন জাতীয় নেতৃত্ব বা জাতীয় স্তরের কোন পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল না।


  • জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের অনেকেই মহাবিদ্রোহ কে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। রজনীকান্ত গুপ্ত মতে সিপাহীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিল। ১৮৫৭ থেকে ৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অসামরিক সাধারণ মানুষেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল সেদিন তিনি দৃষ্টি দিয়েছেন।

  • আম্বালা ও মিরাটে সিপাহী দের প্রথম অভ্যুত্থান ঘটার পরেই বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল দিল্লি দখল করা। কারণ দিল্লি কেবল ভারতের পূর্বতম রাজধানী ছিল না এটি ছিল সম্পদ ও সামরিক সরঞ্জাম এর পরিপূর্ণ একটি অঞ্চল। সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় পরেই গ্রাম ও শহর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল।

  • ১৪ ই মেয়ে মুজাফফরনগরে সাধারণ মানুষের উপস্থান শুরু হয়েছিল এবং এর আগে এই অঞ্চলের সিপাহিদের কোন বিদ্রোহ হয়নি।  বিগ্রেডিয়ার জেনারেল উইলসনকে জানিয়ে ছিলেন শুধু সিপাহী বিদ্রোহ সিপাহীরা নয় জনসাধারণের সাধারণভাবে আমাদের বিরোধী হয়ে উঠেছে। এই ক্ষুদ্র মানুষেরা দিনের পর দিন আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে এবং এটা একটা অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তর নথি পত্র অগ্নিসংযোগ করেছিল।

  • বিহারে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কুনওয়ার সিং নামে এক পতিত ক্ষমতাচ্যুত জমিদার। বিদ্রোহের উত্তাপ পাঞ্জাবকে সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। ঐতিহাসিক সি. বল বলেছেন সমস্ত দেশের সশস্ত্র ভবঘুরের দল যখন লক্ষ্ণর দিকে ফিরে গিয়েছিল এবং ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মৃত্যুবরণ করার জন্য প্রতীক্ষা করেছিল।


 

➤ নতুন রাষ্ট্র ও তার মতাদর্শ : 

১৮৫৭সালের ১১ ই মে সিপাহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে "শাহিন- ই- হিন্দ" বলে ঘোষণা করে। তিনি ছিলেন সিপাহিদের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। বাহাদুর শাহ কে পুনরায় ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু প্রকৃত শাসন ক্ষমতা রাখা হলেও কোর্ট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর হাতে। নতুন রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী তিনভাগে বিভক্ত ছিল পদাতিক ,অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ।


  ১৮৫৭ সালের ৮ অগাস্ট একটি পরোয়ানা জারি করে কোর্টের সদস্যদের দিল্লিতে একটি বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে বলা হল। এই অধিবেশনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থা ও সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ডাক সরবরাহের ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং মহাজন দের থেকে রাষ্ট্রের ঋণ গ্রহণ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এর বিশ্বাস ছিল যে ভূস্বামী অভিযাতরা নামে মাত্র বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা যে দিল্লির মসনদে বাহাদুর শাহ কে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং একটি বিকল্প রাস্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। ভারতীয় বিদ্রোহ কখনোই একটি সিপাহিদের অভ্যুত্থান নয় এটি একটি জাতীয় বিদ্রোহ এবং সিপাহীরা তার হাতিয়ার মাত্র।


👉 মহা বিদ্রোহের ব্যার্থতা


 

Post a Comment

0 Comments