কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মসূচি। Aim of Congress | Modern Indian History

  Modern Indian History | Aim of Congress

জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মসূচি       


www.gkghor.in
Modern Indian History | Indian National Congress | Question Answer


প্রচলিত অর্থে কংগ্রেসকে কোন রাজনৈতিক দল বলা যায় না। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর কোন সংবিধান ছিল না। কোন একজন ব্যক্তি এর প্রধান নেতা ছিলেন না। এমনকি এর কোনো সুস্পষ্ট সংগঠন ও মজুদ অর্থভাণ্ডার ছিল না। আসলে কংগ্রেস ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের একটি মহা মিলন কেন্দ্র। অনেকেই কংগ্রেসের এই বাৎসরিক অধিবেশনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষাকরতেন। সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস ভারতের সমস্ত মানুষের  প্রতিনিধি বলে মনে করত এবং ভারত ও ভারতবাসীর স্বার্থে আন্দোলন পরিচালিত করত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত কংগ্রেস তার লক্ষ্য ও কর্মসূচি স্থির করে অনেকাংশেই নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ছিল। কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনার আগে কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তি সম্পর্কে দু-চার কথা বলা প্রয়োজন, তা নিচে দেওয়া হল।


 সামাজিক ভিত্তি :

কংগ্রেস ছিল সমাজের উপর তলার মানুষের প্রতিষ্ঠান। সাধারণত নিম্নবর্গের মানুষের সেখানে কোন ঠাঁই ছিল না। কিন্তু সমাজের উপর তলার মানুষের নানা স্তর ভেদ ছিল। এদের মধ্যে কারা কংগ্রেসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল সে বিষয়ে সংশয় এর অবকাশ আছে। এ বিষয়ে নানা মতবিরোধ আছে। কংগ্রেস হলো একটি বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান এই অভিমত সর্বাংশে সত্য নয়। প্রথম যুগের কংগ্রেস সম্পর্কে ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, প্রথম যুগের কংগ্রেস তহবিলে যারা মোটা টাকার অর্থ সাহায্য করতেন তারা বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীভূক্ত নন। এই টাকা আসত দ্বারভাঙ্গার মহারাজের মত বিরাট জমিদার ও বরোদার মত দেশীয় রাজাদের কাছ থেকে। জমিদার শ্রেণী কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের সংখ্যা কখনোই বেশি ছিল না। কংগ্রেস ছিল সাধারণভাবে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত শহরবাসী মধ্যবিত্তদের প্রতিষ্ঠান।


 কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী সদস্য :

কংগ্রেসের অধিবেশনে যারা অংশ নিতেন তাদের সিংহভাগ ছিলেন হিন্দু। কারণ তারা অধিক সংখ্যায় ইংরেজি শিক্ষা বরণ করে নিয়েছিলেন। আবার হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্য আমাদের বিশেষভাবে নজরে পড়ে। অশিক্ষিত ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের কংগ্রেসের ঠাঁই হয়নি। কংগ্রেসের এই সীমাবদ্ধতার তীব্র সমালোচনা করে লালা লাজপত রায় মন্তব্য করেছিলেন "The Congress movement was neither inspired by the people, nor devised or planned by them. It was a movement not for within". অন্যদিকে কংগ্রেস অধিবেশন গুলিতে যোগদানকারী মুসলিম সদস্যদের সংখ্যা ও বিশেষ ছিল না। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে একমাত্র বদরুদ্দীন তায়েবজি ছাড়া অন্য কোন মুসলিম নেতার নাম পাওয়া যায় না। অথচ কংগ্রেস ছিল ধর্মনিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠান। তায়েবজী মুসলমানদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, কংগ্রেসে যোগ দিলে তাদের উপকারী হবে। স্যার সৈয়দ আহমদকেও তিনি অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি যেন কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় তাকে জানিয়েছিলেন "I object to every congress in any shape or form which regards India as one nation". এই পর্যন্ত আমাদের আলোচনার বিষয় থেকে আমরা বলতে পারি যে, কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তি ছিল সমাজের উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। সাধারণভাবে জমিদার, আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষেরা কংগ্রেসে ছিলেন। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অশিক্ষিত ও অনুন্নত শ্রেণীর মানুষ কংগ্রেস থেকে দূরে ছিলেন।


 লক্ষ্য ও কর্মসূচি (Aim and Objects) :

1885 থেকে 1905 পর্যন্ত প্রায় কুড়ি বছর যাবৎ কংগ্রেসের লক্ষ কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন নরমপন্থী নেতারা। যাদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া বা সমঝোতা করে চলা। উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি, ফিরোজ শাহ মেহতা, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রানাডে, আনন্দ চার্লু, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, বদরুদ্দীন তায়েবজি প্রভৃতি কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা মনে করতেন যে ভারতীয়দের ন্যায্য দাবি গণতন্ত্রের পূজারী ও ঐতিহ্যবাহী ইংরেজরা নিশ্চয়ই মেনে নেবে।

কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আমরা দুটি দৃষ্টিকোণেই বিচার করতে পারি। বলতে গেলে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেতিবাচক ও ইতিবাচক এই দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর ছিল।


 কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য:

কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য গুলির মধ্যে অন্যতম হলো- 1. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ও গণতান্ত্রিক পথে একটি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা 2. জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা। 3. একটি সর্বভারতীয় নেতৃত্ব প্রদান করা ও 4. উপনিবেশিকতা বিরোধী আদর্শ ও তত্ত্ব প্রচার করা। কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন পরিচালনা করা। কংগ্রেস প্রথমে কোন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে চায় নি বা পারেনি। কংগ্রেসের মধ্যে নানা মত ও পথের মানুষের ঠাঁই  হয়েছিল। ঐক্যের সুর সবসময় না বাজলেও একটি লক্ষ্যে সবাই ছিল স্থির ও অবিচল।

        কংগ্রেস নেতাদের দাবি গুলিকে মোটামুটিভাবে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যা, যথা- রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক।


রাজনৈতিক কর্মসূচি :

কংগ্রেসের রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ ও অধিকার অর্জন করা। 1861 সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল আইন (Indian Council Act) ও লর্ড রিপনের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্কার তাদের আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী করেছিল। কংগ্রেসের দাবি ছিল ভারত সচিবের কাউন্সিল বিলুপ্ত করা। এর পরিবর্তে ভারত সচিব কে সাহায্য করার জন্য কমন্স সভার এক স্টাডিং কমিটি নিয়োগ করা। তাদের অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল ভারতের শাসন কাঠামো দেশীয় প্রতিনিধিদের আরও ক্ষমতা দান। সেই সঙ্গে সঙ্গে বড়লাটের আইন পরিষদ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ গুলির সম্প্রসারণ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়োগ।


 প্রশাসনিক সংস্কার:

রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি কংগ্রেস নেতাদের কাছ থেকে প্রশাসনিক দাবিও উঠে এসেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন সরকারি পদে ভারতীয়দের নিয়োগ। সরকারি কাজের দ্রুত ভারতীয়করণ এর উদ্দেশ্যে তারা চেয়ে ছিলেন যে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও আইসিএস (ICS) পরীক্ষা গ্রহণ করা হোক এবং এই পরীক্ষার সর্বোচ্চ সময়সীমা করা হোক 23 বছর। কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থেই যে আর্থিক সংখ্যক ভারতীয় কর্মচারী নিয়োগের দাবি করা হয়েছিল তা নয়। বিদেশী কর্মচারীদের বেতন, অবসরকালীন ভাতা বৃদ্ধি ও ভারত থেকে নিষ্কাশন বন্ধ করতেও এই দাবি তোলা হয়েছিল।


 অর্থনৈতিক সংস্কার :

 কংগ্রেস নেতাদের কর্মসূচির আরেকটি অন্যতম দিক হলো অর্থনৈতিক সংস্কার। এই বিষয়টিকে আমরা দু'ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি। প্রথমত, এর একটি তাত্ত্বিক দিক আছে। কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতা দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সর্বপ্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়টি উন্মোচিত করে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। এদের অর্থনৈতিক চিন্তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো এই যে উপনিবেশিক শাসনের ইংরেজরা নিজেদের দেশ ও জাতির স্বার্থে ভারতের অর্থনীতি কে ব্যবহার করেছে। জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার সম্ভবত সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল মূল সম্পদ নিষ্কাশন তত্ত্ব (Drain of Wealth)। রমেশচন্দ্র দত্ত এই তত্ত্ব  আবিস্কার না করলেও তার হাতেই এ তত্ত্ব সবচেয়ে জোরালো ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ভারতের সম্পদ ভারতের হাতছাড়া হয়ে ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধশালী করছিল। দাদাভাই নওরোজি মতে, ভারতের দারিদ্র্যের এটাই সব চেয়ে বড় কারন।

 উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে কংগ্রেসের দাবিও কর্মসূচি কিন্তু কেবলমাত্র ধনী জমিদার শিল্পপতি ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই গৃহীত হয়নি। সাধারণ মানুষের কথাও তারা ভেবেছিলেন। লবণ আইন বহির্ভূত ভারতীয়দের প্রতি অত্যাচার, বন সংরক্ষণ আইন প্রভৃতি নিয়ে কংগ্রেস নেতারা মাথা ঘামিয়ে ছিলেন। সামগ্রিকভাবে কৃষক ও শ্রমিকদের দাবি দেওয়া-নেওয়া তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য কংগ্রেস সক্রিয় ছিল না। কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি তাদের সহানুভূতি মায়া কান্না ছাড়া আর কিছু ছিল না। দাদাভাই নওরোজি অবশ্য এই মনোভাবের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি কোন ভনিতা না করে বলেছেন- আমরা নিজেদের শ্রেণীর ছাড়া অন্যদের সম্পর্কে কতটুকু জানি। সুতরাং অন্যান্য শ্রেণীর দাবি নিয়ে কংগ্রেস আলোচনা করবে - এ কাজ আমাদের নয়।


👉 জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা

Post a Comment

0 Comments