জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা | Indian National Congress | Modern Indian History

 Indian National Congress

  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা

www.gkghor.in
Modern Indian History | Establishtment of Indian National Congress


             1985 খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর সভাপতিত্বে মুম্বাই শহরে আহুত জাতীয় কংগ্রেসের সূচনা কে কেন্দ্র করে নানা মত তর্ক-বিতর্ক আছে। কে বা কারা এবং কেন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। যে ভাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ান অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নিয়েও অনেক কথা উঠেছে।


জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্কিত মত :     

 প্রথমে আমরা আলোচনা করব কংগ্রেসের জন্ম দাতা কে বা কারা সেই বিষয়ে। পট্টভি সীতা রামায়ানের মতে, 1877 সালে অনুষ্ঠিত দিল্লি দরবারই নাকি প্রথম একটি জাতীয় সভা আহবানের প্রেরণা দেয়। এছাড়াও 1883 সালে কলকাতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় নেতারা এর অনুকরণে একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। প্রথম কংগ্রেসের অন্যতম সদস্য সুব্রামনিয়া আইয়ারের মতে, কংগ্রেসের উৎস অনুসন্ধান করতে হবে এই আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মধ্যে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে 1884 সালে লর্ড রিপনের (Lord Ripon) বিদায় সভা অনুষ্ঠানের মধ্যেই কংগ্রেসের জন্ম রহস্য লুকিয়ে আছে। অন্যদিকে 1883 সালে কমন্স সবার একজন আইরিশ সদস্য, যার নাম ওডোনিল, একটি চিঠিতে জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। 1883 সালের পহেলা মার্চ অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম (O. A . Hume) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। এই চিঠিতে তিনি তাদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে ও দেশের উন্নয়নমূলক কাজে এগিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। 


এরপর তিনি 1884 সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (Indian National Union) প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত দরদী হিউমের লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন এর মাধ্যমে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তার এই ইচ্ছা অবশ্য তখনই বাস্তবায়িত হয়নি। লর্ড রিপনের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য তিনি ভারতবাসীকে উপদেশ দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে 1885 সালে তিনি বড়লাট ডাফরিনের ( Lord Duffrine) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তার কাছে প্রস্তাব করেন। তিনি এই প্রস্তাবে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান এবং শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগেই নাকি কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হিউমকে যারা স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চম সভাপতি ও হিউমের জীবনীকার উইলিয়াম ওয়েডার্বান, পট্টভি সিতারামাইয়া এবং প্রখ্যাত মার্কসবাদী (Marxist) লেখক রজনীপাম দত্ত।


চরমপন্থী মতবাত (Extremist View)

অন্যদিকে 1916 সালে  চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায় তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া (Young India) গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, লর্ড ডাফরিনেই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেছেন Congress Was Product Of Duffrine's Brain. 1916 সালে চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায় নরমপন্থী নেতাদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে "নিরাপত্তামূলক যন্ত্র" (Safety Valve Theory) তত্ব ব্যবহার করে বলেন যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখা।


থিওসফিস্ট মতবাত (Theosophist View)

আবার কয়েকজন অন্যান্য ঐতিহাসিক মনে করেন যে থিওসফিস্ট্রি কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা। লক্ষ্য করার বিষয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হিউম বা থিওসফিস্টদের দাবি জোরালো ভাষা উচ্চারিত হলেও কেউই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায সুরেন্দ্রনাথ এর অবদান সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। একদিক থেকে হয়তো তা অসঙ্গত নয়। কারণ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি কখনোই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। অন্যদিকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে থিওসফিস্ট বা হিউম কারোরই দাবি স্বীকার করেন না। বস্তুত কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের অবদান মেনে নিলেও একথা স্বীকার করতেই হবে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতবাসী এই ধরনের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই হিউমের প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিল এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিলেও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা সমস্ত ব্যাপারটিকে এই দিক দিয়ে বিচার করলে হিউম কে জাতীয় কংগ্রেসের জনক বলে মেনে নেওয়া কঠিন।


অন্যান্য মতবাত :

কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লর্ড ডাফরিন এর দাবি আরো দুর্বল। ডাফরিন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আদৌ উৎসাহী বা আগ্রহী ছিলেন না। তার চিঠিপত্র থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। লর্ড ডাফরিন এর সঙ্গে হিউমের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। হিউমের প্রস্তাব তিনি সুনজরে দেখেন নি। লর্ড ডাফরিন আশঙ্কা করেছিলেন যে কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে। ভারতের শিক্ষিত সমাজ সম্পর্কে তিনি অবহেলার ভাব পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন না যে, ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কোন যোগ্যতা আছে। হিউম যে 7 খন্ড সরকারি নথি থেকে ভারতে আসন্ন গণবিদ্রোহের আশঙ্কা করেছিলেন। তার প্রথম উল্লেখ পায় তার জীবনীকার Oedern Bern গ্রন্থে। অমলেশ ত্রিপাঠী, বিপান চন্দ্র প্রভৃতি আধুনিক ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছেন। প্রথমত যে 7 খন্ড সরকারি নদীর উপর নির্ভর করে এক গণবিদ্রোহের আশঙ্কা করেছিলেন এবং যার উপর ভিত্তি করে উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন বিপান চন্দ্র।


কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য (Aim of Congress) :

উনিশ শতকের শেষ পর্বে কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়েছিল বলেই তার উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল। সেই প্রয়োজন হলো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব আন্দোলন শুরু হয়েছিল বা বিক্ষিপ্ত ভাবে গড়ে উঠেছিল এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেভাবে আলাদা আলাদা করে নিজস্ব সংগঠনের স্থাপন করেছিল, তার ফলে কোন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রিটিশ সরকার এই বিষন্নতা ও অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ভারতবাসীকে তার ন্যায্য অধিকার ও দাবি থেকে বঞ্চিত করছিল। শিক্ষিত ভারতবাসী ও নিজেদের এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীকে এক অখণ্ড ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করা। ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই যে কংগ্রেসের অধিবেশন প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত হবে এবং যে অঞ্চলে সেই অধিবেশন হবে সেই অঞ্চলের কোন নেতা সভাপতি হতে পারবেন না। কংগ্রেসে যাতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে তার উপরেও যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছিল। যেখানে ভারতের সমস্ত প্রান্তের মানুষ সমবেত হয়ে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে। ভারতীয় নেতারা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশ ও জাতির স্বার্থে। এছাড়া তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। সরকার সমস্ত জিনিসটিকে যেভাবেই হোক না কেন কংগ্রেস নেতারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।


হিউম যখন কংগ্রেস স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন, তখন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া হতে কোন অসুবিধা হয়নি। তারা হিউমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, এর ফলে তারা সরকারের বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে রক্ষা পাবেন এবং তার মত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী উপস্থিতি সরকারের মন থেকে সর্ব প্রকার সন্দেহ দুর করবে। সুতরাং হিউম যদি কংগ্রেসকে ব্যবহার করতে চেয়ে থাকেন নিরাপত্তামূলক যন্ত্র হিসাবে তাহলে তারাও হিউম কে ব্যবহার করতে চেয়ে ছিলেন নিজেদের প্রয়োজনে, সরকারের সমস্ত প্রকার সম্ভাব্য বিরোধিতা দুর করতে। হিউম যে প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তামূলক যন্ত্র ভেবে আত্মতৃপ্তি বোধ করেছিলেন অল্পকালের মধ্যেই দেখা গেল ব্রিটিশ সরকারের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।



Post a Comment

0 Comments