মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস | Mauryan Dynasty | Indian History

 Mauryan Empire | Ancient History


www.gkghor.in
Ancient Indian History | Mauryan Empire In Bengali | Mauryan Dynasty | Indian History | History


মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস:

        মৌর্য রাজারা প্রায় ১৪০ বছর ভারতে রাজত্ব করেন। তাদের রাজত্বকালে ভারত, আফগানিস্তানের সিংহভাগ অঞ্চলজুড়ে এক অখণ্ড রাষ্ট্রের উত্তোলন হয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুসংহত, সুবিন্যাস্ত হলো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনে, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে দেখা দিল অভূতপূর্ব উন্নতি।


 প্রশাসনিক ব্যবস্থা : 

মৌর্য যুগে রাস্ট্র ছিল রাজতান্ত্রিক। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। রাজারা নিজেদের দেবতাদের "প্রিয়" বলে উপস্থাপিত করেছিলেন। মৌর্যদের আরেকটি উপাধি ছিল "প্রিয়দর্শী"। রাজা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সৈন্য বাহিনী ছিল তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে, কোষাগার ছিল তার তত্ত্বাবধানে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র রাজার অপরিসীম ক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করছে। প্রচন্ড কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে রাজার দিন অতিবাহিত হতো। 

 

 মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ:  

শাসনকার্যে মন্ত্রী ও আমতদের গুরুত্ব বলতে গিয়ে কৌটিল্য একটি সুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন।  মন্ত্রীদের সংখ্যা সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কার্যত রাজার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কৌটিল্যের মতে, মন্ত্রীদের অধিবেশন নিয়মিত হতো না, হতো রাজ্যে জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। রাজার অনুগ্রহের ওপরেই তাদের প্রতিপত্তি মান মর্যাদা নির্ভর করত।



 সমাহর্তা ও সন্নিধাতা: 

কেন্দ্রীয় সরকারের দুজন পদস্থ রাজপুরুষ হলেন সমাহর্তা ও সন্নিধাতা। সমাহর্তা ছিলেন রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা। যে অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রী রাজকোষ ও কোষাগারে জমা পড়তো তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সন্নিধাতা। এছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও তাদের অধিকতা শাসনকার্য পরিচালনায় ভূমিকা নিয়েছিল। এরা হলেন স্ত্রী অধ্যক্ষ, ধর্ম মহাপাত্র, রূপ দর্শক, গুপ্তচর, দুত প্রমূখ। 

 


 প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা:

শাসনকার্যে সুবিধার জন্য মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। যথা - উত্তরাপথ, অবন্তী, দক্ষিণা পথ, উত্তর কলিঙ্গ, দক্ষিণ কলিঙ্গ, প্রাচ্য। প্রথম শাসনকর্তা পদে সাধারণত রাজকুমারদের নিয়োগ করা হতো। অশোক ও কোনাল উভয়ই রাজ্যভার গ্রহণের পূর্বে প্রাদেশিক শাসনকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ছিল তেমনি প্রদেশকে সাহায্য করার জন্য অমর্ত্য ও মহামাত্রদের নিয়ে গঠিত একটি মহামাত্র পরিষদ ছিল। অধ্যাপক ভান্ডারকর মনে করেন, প্রদেশ পরিচালনায় অবন্তী ও উত্তরাপথের শাসকদের যে কৃতিত্ব ছিল, কলিঙ্গ প্রদেশের রাজ্যপাল এর সে অধিকার ছিলনা।


 বিচার বিভাগ:

অর্থশাস্ত্রে ধর্মস্থ ও উপদেষ্টা নামে দুই শ্রেণীর বিচারকের উল্লেখ আছে। বিচার ব্যবস্থায় দন্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা নীতি প্রবর্তন করা হয়। ফৌজদারি দন্ডবিধির কঠোরতা বহুলাংশে হ্রাস করা হয়। কারা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন প্রসাস্থা নামে এক শ্রেণীর রাজপুরুষ।


 সামরিক বিভাগ:

মেগাস্থিনিস বলেন সামরিক বিভাগের পরিচালনার ভার 30 সদস্যের এক সরকারি সংস্থার উপর ন্যস্ত ছিল। অশ্বারোহী, হস্তী বাহিনী, নৌবহর, পদাতিক, রথারোহী ইত্যাদি বিভাগের উল্লেখ আছে। এক একজন  অধ্যক্ষ এক একটি শাখা পরিচালনা করতেন।


 সমাজ জীবন:

বর্ণ ও আশ্রম ভিত্তিক সামাজিক জীবন প্রতিফলিত হয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। কৌটিল্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় জীবনের ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য শিক্ষা ও সন্ন্যাসী এই চারটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। বিবাহ একই বর্ণের ভেতর হত কিন্তু বিভিন্ন গোত্রে। মেয়েদের স্বার্থের প্রতি কৌটিল্য উদাসীন নয়। ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদের বিদ্যা অর্জনের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। অভিজাত পরিবারের মেয়েদের এমন অবাধ গতিবিধির অধিকার ছিল না। সমাজের নিম্ন স্তরে শুদ্রদের উল্লেখ আছে। কৌটিল্য দাস প্রথার উল্লেখ করেছেন। যোগিমারা গুহালেখে সুতনুকা নামে জৈনিক  দেবদাসীর উল্লেখ আছে ।



 সমাজ ও রাষ্ট্র:

সমাজে বিশেষ করে বহুজাতিক রাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা আছে। অশোক বুঝেছিলেন সমাজের কল্যাণের জন্য আইন বিধি প্রয়োগের চেয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো অনেক বেশি জরুরী। এভাবে জন্মের ওপর কর্মকে স্থান দিয়ে, মানবিকতার আদর্শ প্রচার করে, অশোক সমাজ জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন।


 অর্থনৈতিক জীবন :

জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে রাজ্যের সমস্ত জমির উপর রাজার তথা সরকারের এক বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। মৌর্য অর্থনীতিতে কৃষির বিকাশ তথা উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পতিত জমি আবাদ যোগ্য করে তোলার কাজে ভূমিকা ছিল। কৃষি অর্থনীতিতে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা অন্যদিকে তেমনি ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বলিষ্ঠ ছাপ। চাষাবাদের কাজে বৃষ্টির উপর পুরোপুরি নির্ভর করলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। মৌর্য যুগের কৃষি ফলন যে সন্তোষজনক ছিল মেগাস্থিনিস ও  কৌটিল্যের বর্ণনায় তার প্রমাণিত হয়েছে। কৃষির উন্নতির পরোক্ষ ফল শিল্পায়ন। কৃষিজাত উদ্বৃত্তের সৃষ্টি হওয়ায় এক শ্রেণীর লোক সর্বক্ষণের জন্য বিভিন্ন কারিগরি শিল্পে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পান। অগ্রগতি ঘটেছিল খনি ও ধাতুবিদ্যা। খনিজ সম্পদে ভারতের সমৃদ্ধির উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস ও কৌটিল্য। অস্ত্রসম্ভার এর বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যায়। চর্ম শিল্পে ভারতীয়দের দক্ষতার কথা বলেছেন এরিয়ান। এছাড়াও দেশি-বিদেশি পদ্মরাগ, নীলকান্তমণি, মুক্তা, বজ্রও প্রবাল এর উল্লেখ আছে। এই পর্বে পাত্র শিল্পেও বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখা যায়।


    মৌর্যযুগে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যেরও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। বণিক সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার প্রতি রাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। বাণিজ্য চলত স্থল ও জল উভয় পথেই। যাতে পণ্যের জোগান পর্যাপ্ত ও নিয়মিত থাকে এবং ক্রেতা ও উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেজন্য রাজ্য রাজার থেকে পণ্য কিনে মজুদ ভান্ডার করে তুলত। ব্যবসায়ীরা যাতে ক্রেতা সাধারণের কাছে থেকে অতিরিক্ত মুনাফা না লুটতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল। মধ্যযুগের বাণিজ্য বিশেষত আন্তঃবাণিজ্য লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে। আমলাতন্ত্রের পরিপালন সৈন্যবাহিনীর ভরণপোষণ প্রজা কল্যাণ মূলক কাজের অনুষ্ঠান প্রভৃতি অবশ্যকরণীয় কার্যাদি সম্পন্ন জন্য রাজা তথা রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রয়োজন ছিল। "পাঞ্চ মার্ক" মুদ্রা ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে।


মৌর্য যুগের ধর্মীয় জীবন: 

মৌর্য যুগের জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মানুষের আত্ম পিপাসা নিবারণের জন্য বুদ্ধ এই পর্বে ঈশ্বর রুপে কল্পিত ও পূজিত হন। অশোক সপ্তম স্তম্ভ অভিলেখে আজীবিক সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ এসময় বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পতঞ্জলি মহাভাষ্য থেকে জানা যায় এই সময় রাজারা শিব, স্কন্ধ ও বিশাখার মূর্তি তৈরি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন।

  


ভাষা ও সাহিত্য: 

মৌর্য যুগের প্রাকৃত, সংস্কৃত ভাষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। লোকভাষা বলে বৌদ্ধ ও জৈন মহলে প্রাকৃত ভাষার যথেষ্ট সমাদর ছিল। জৈন গুরু ভদ্রবাহু ও স্থূল ভদ্র এই যুগে আবির্ভূত হন। ভদ্রবাহু "কল্পসূত্র" নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। "পূর্বমীমাংসা সূত্র" এই সময় রচিত হয়। অনেকে মনে করেন মহাকবি বাল্মিকী এই যুগে আবির্ভূত হন। 


স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: 

মৌর্য যুগের শিল্প সৃষ্টির পেছনে বৈদেশিক অনুপ্রেরণা কাজ করেছ। অশোক স্তম্ভের মধ্যে সারনাথের স্তম্ভটি নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। দির্ঘ, শুঠাম, উপরের দিকে ক্রমশ এককভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অতি মসৃণ অশোকস্তম্ভ মৌর্য ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মৌর্য শিল্পে পারসিক প্রভাব ধরা পড়েছে স্তম্ভের অত্যাশ্চর্য মসৃণতায়, উল্টানো পদ্মর সংযোজনায় ও প্রাণী ভাস্কর্যে। মৌর্য উত্তর পর্বে ভারতীয় শিল্পের পাথরে উপকরণ প্রয়োগের যে ব্যাপকতা দেখা যায় তার ভিত্তি মধ্যযুগে রচিত হয়।

 

             মৌর্য যুগ ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায় রূপে চিহ্নিত। এ সময়ে প্রায় সারা ভারতজুড়ে যে এক অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রগঠনের সার্থক প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল ঠিক তেমনটি আর কখনো ঘটেনি। রাজ্যের তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতার কথা এই যুগ এই প্রথম ঘোষিত হয়েছিল। মৌর্য যুগ বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও পরিপুষ্টির যে আদর্শ উচ্চারিত হয়েছিল তা মৌর্য পর্বকে অভিনবত্ব দান করেছে।


👉বৌদ্ধধর্ম | Buddhism | Ancient Indian History MCQs


Post a Comment

0 Comments