ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার বিস্তার | Modern Education in British India | Modern Indian History

 Modern Education in British India

 আধুনিক শিক্ষার বিস্তার


আজকের এই পর্বে আমরা আপনাদের জন্য আধুনিক ভারতের ইতিহাস থেকে ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা বিস্তারের উপর আলোচনা করেছি। 


www.gkghor.in
Modern Indian History | Indian History


উডের ডেসপ্যাচ (Wood's Despach) :  

কোম্পানির আমলে ভারতের আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্রপাত হলেও 1854 সালে স্যার চার্লস উডের ডেসপ্যাচ বা শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব ছিল, শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এবং এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই ভারতে আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল। উড তার প্রস্তাবে ইংরেজি ও আধুনিক ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা (Wester Education) বিস্তারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি প্রত্যেক প্রদেশে শিক্ষাদপ্তর খোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাছাড়া কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সুপারিশ তিনি করেছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। দক্ষ শিক্ষকের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য তিনি শিক্ষণ শিক্ষা কেন্দ্র বা শিক্ষকদের ট্রেনিং কলেজ স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উডের এই সব প্রস্তাব ধাপে ধাপে কার্যকরী করা হয়। বাংলা, মুম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে 1855 সালে শিক্ষা দপ্তর খোলা হয়। এইসব দপ্তরের প্রধান দায়িত্ব ছিল সরকারি উদ্যোগে সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ও সেগুলি দেখাশোনা করা। সরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তত্ত্বাবধান করা ছাড়াও তারা বেসরকারি বিদ্যালয় গুলিকে আর্থিক সাহায্য দিত ও সেগুলির কাজ কর্মের দিকে নজর রাখতো।


মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল। স্কুলের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছিল। 1982 সালের মধ্যে সারা ভারতে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র 1363। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উডের সুপারিশ অনুসারে 1857 সালে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে এইসব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছিল। এদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মহাবিদ্যালয় গুলির অনুমোদন করা, পরীক্ষা গ্রহণ করা ও উপাধি প্রদান করা।


হান্টার কমিশন (Hunter Commission):

ভারতের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো রিপন (Lord Ripon) এর আমলে 1882 সালে হান্টার কমিশন নিয়োগ। এই কমিশন নিয়োগ এর উদ্দেশ্য ছিল উডের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাব বা নির্দেশনামা কিভাবে এবং কতটুকু কার্যকরী করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা এবং সফল করার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত তা সুপারিশ করা। 1857 থেকে 1882 সালের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্র সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলেও সমগ্র দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে তা আদৌ উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যেভাবে সরকারি অনুদান দেওয়া হতো তা নিয়েও যথেষ্ট সমালোচনা অবকাশ ছিল। হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা, স্ত্রী শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির অবস্থার উন্নতির ওপর জোর দেওয়া হয় এবং আর্থিক সাহায্য দান এর সুপারিশ করা হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারি অর্থ অনুদানের প্রস্তাব করা হয়। উল্লেখযোগ্য হল যে উচ্চশিক্ষার (Higher Education) ক্ষেত্রে কোন সংস্কারের প্রস্তাব হান্টার কমিশন রাখেননি। এমনকি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের জন্য কোন সুপারিশ করা হয়নি।


হান্টার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ সরকার মেনে নেয়। স্থানীয় বোর্ড ও পৌরসভার হাতে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ উৎসাহিত হয়। এই অবস্থায় 1882 সাল থেকে 19 শতকের শেষ পর্যন্ত সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটে।


           কলেজ শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছিল, 1882 সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় (Panjab University) ও ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়(Allahabad University) স্থাপিত হয়। সরকারি উদাসীনতা সত্বেও কলকাতায় ২০ টি এবং সমগ্র প্রদেশের 26 টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৯ সালে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন কলেজ(Metropolitan Institution College) উন্নীত হয়।১৮৮০ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রিপন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, বর্তমানে যা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ নামে পরিচিত।  


লর্ড কার্জনের আমলে শিক্ষার বিস্তার:

বিংশ শতকের সূত্রপাত হয় লর্ড কার্জনের(Lord Carzon) রাজত্বকাল দিয়ে। ভারতের ইতিহাসে লর্ড কার্জন একজন অত্যন্ত বিতর্কিত ব্যক্তি। ভারতীয় দৃষ্টিতে লর্ড কার্জন ও সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার প্রতীক কিন্তু সত্যতা এটাই যে তিনি ভারতবাসীদের জন্য অন্তত কিছু ভাল কাজ করেছিলেন। ভারতের শিক্ষা সংস্কারের ইতিহাসে তার দান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এই উদ্দেশ্যে সিমলা শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে শিক্ষা নীতি নির্ধারণ সম্পর্কে ১৫০টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিমলা সম্মেলন ও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের আলাপ আলোচনার উপর ভিত্তি করে শিক্ষানীতি ঘোষিত হয় এবং 1904 সালের ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ আইন(Indian University Act) প্রণীত হয়। ১৯০৪ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি আইনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় | বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিছক পরীক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র হিসাবে না রেখে পঠনপাঠন ও গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে অধ্যাপক নিয়োগ, পাঠাগার স্থাপন, বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারের ইত্যাদিও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। 


স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission):

1905 সালের পর থেকেই শিক্ষানীতির সুফল ফলতে শুরু করে। কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পঠন-পাঠন শুরু হয়। এইসব কাজের জন্য সরকার অর্থসাহায্য মঞ্জুর করতে থাকে। 1916 সালে মদনমোহন মালব্যের প্রচেষ্টায় ভারতের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। 1917 সালে পাটনা ও মহেশপুরে এবং 1958 সালে হায়দ্রাবাদে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। 1921 সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক বোলপুর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের (Viswa Bharati University) প্রতিষ্ঠিত হয়। 1917 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম কিভাবে চলছে তা পর্যালোচনা করার জন্য ডক্টর মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নিযুক্ত করা হয়। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই কমিশনের একজন সদস্য। 1919 সালের আগস্ট মাসে এই কমিশনের রিপোর্ট পেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে নানা সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই কমিশন কয়েকটি প্রস্তাব সুপারিশ করে। শিক্ষা জগতে সরকারি হস্তক্ষেপ যথাসম্ভব কম করা যায় তার উপরেই কমিশন জোর দেয়। তাছাড়া উপযুক্ত নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে যোগ্য অধ্যাপক নিয়োগ, ছাত্রদের উন্নতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ এবং স্নাতক পাঠক্রম চালু করার প্রস্তাব করা হয়। অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে দু'বছরের ইন্টারমিডিয়েট পাঠক্রমের সূত্রপাত, তিন বছরের স্নাতক পাঠক্রম, বিদ্যালয় স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ছিল। সরকার স্যাডলার কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে 1919 সালের মন্টেগু চেমসফোর্ড (Montegu-Chemsfort Act) সংস্কার আইনের শিক্ষা বিভাগ কে কেন্দ্র সরকারের হাত থেকে প্রাদেশিক সরকার হাতে তুলে দেওয়া হয়।


জাতীয় শিক্ষানীতি: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Education Council):

ইংরেজ আমলে বিদেশি শিক্ষানীতির দোষ ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অনেকেই সচেতন ছিলেন। তাই বিকল্প এক শিক্ষানীতি গড়ে তোলার জন্য উনিশ শতকে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো দেশের দিকে তাকিয়ে এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। উনিশ শতকের জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট রূপ নিতে পারেনি। 1905 সালে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন সেই সুযোগ এনে দিলো। স্বদেশী আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে কেবল বিদেশি দ্রব্য সামগ্রী বয়কটই বোঝাত না, বিদেশি শাসন ও শিক্ষার বয়কট বোঝাত। 1906 সালের 11 ই মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হলো জাতীয় বিদ্যালয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। চাকরির বাজারে পরিষদের ডিগ্রির কোন দাম ছিল না। ফলে ছাত্রসমাজের বৃহৎ অংশের দ্বারা আকৃষ্ট হয়নি। তাছাড়া সরকারি দমননীতির ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল।


জাতীয় শিক্ষা পরিষদ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও যেটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। তার গুরুত্ব অপরিসীম | জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে এই প্রথম কার্যকর ভাবে কিছু করার চেষ্টা হয়েছিল। এই প্রচেষ্টায় বড় কথা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচালক ছিল। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উত্তরসূরি হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (Jadavpur University) আজও বর্তমান।


👉শিল্পায়ন | Industrialization In Colonial Period 

Post a Comment

0 Comments